প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন পাওয়ার নিয়ম
আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আর এই প্রবাসীদের বিদেশযাত্রা সহজ করতে এবং দেশে ফিরে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে বিভিন্ন ধরণের লোন বা ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকটি প্রবাসীদের স্বপ্নপূরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আজকের এই পোস্টে আমরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন সম্পর্কিত সকল খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনি যদি বিদেশ যেতে আগ্রহী হন বা বিদেশ থেকে ফিরে দেশে কিছু একটা করতে চান, তবে এই পোস্টটি আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কেন এবং কাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মূলত দুটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে:
১. অভিবাসন ঋণ: যারা কাজের জন্য বিদেশে যেতে চান, কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে যেতে পারছেন না, তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা।
২. পুনর্বাসন ঋণ: যেসব প্রবাসী কর্মী বিদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে দেশে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের লোনের প্রকারভেদ
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কথা মাথায় রেখে বেশ কয়েক ধরণের লোন চালু করেছে। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লোন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
অভিবাসন ঋণ (Migration Loan)
যারা নতুন করে বিদেশে কাজের জন্য যাবেন, তাদের ভিসা প্রসেসিং, বিমান ভাড়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়।
- লোনের পরিমাণ: সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
- সুদের হার: ৯% (সরল সুদ)।
- পরিশোধের মেয়াদ: সর্বোচ্চ ৩ বছর (২ মাস গ্রেস পিরিয়ড সহ)।
পুনর্বাসন ঋণ (Rehabilitation Loan)
বিদেশ ফেরত কর্মীদের দেশে ব্যবসা, কৃষি খামার, বা অন্য কোনো আয়বর্ধক প্রকল্প শুরু করার জন্য এই ঋণ প্রদান করা হয়।
- লোনের পরিমাণ: প্রকল্পের ধরনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিমাণে ঋণ দেওয়া হয়।
- সুদের হার: তুলনামূলকভাবে কম।
বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ
এই বিশেষ স্কিমের আওতায় বিদেশ ফেরত কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়।
- সুদের হার: পুরুষদের জন্য ৯% এবং মহিলাদের জন্য ৭% (সরল সুদ)।
- যোগ্যতা: অভিবাসী কর্মীর পরিবারের সদস্য (বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান)।
বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরে আসা কর্মীদের জন্য এই বিশেষ ঋণ চালু করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তাদের দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন পাওয়ার যোগ্যতা ও শর্তাবলী
লোনের ধরণের উপর ভিত্তি করে যোগ্যতার কিছু পরিবর্তন থাকলেও সাধারণ কিছু শর্ত নিচে দেওয়া হলো:
- আবেদনকারীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
- বয়স সাধারণত ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হতে হয়।
- বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বৈধ ভিসা, পাসপোর্ট এবং, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET) এর স্মার্ট কার্ড থাকতে হবে।
- বিদেশ ফেরতদের ক্ষেত্রে প্রস্থানের এবং প্রত্যাবর্তনের প্রমাণপত্র (পাসপোর্টের সিলসহ পাতা) দেখাতে হবে।
- ব্যাংকের নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী এক বা একাধিক জামিনদার প্রয়োজন হবে।
লোন আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন পেতে হলে আপনাকে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। নিচে একটি সাধারণ তালিকা দেওয়া হলো:
- আবেদনকারীর সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি।
- পাসপোর্ট, ভিসা এবং BMET স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি।
- নাগরিকত্ব সনদ (ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত)।
- জামিনদারের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি এবং ঠিকানা সম্বলিত সনদ।
- জামিনদারের স্বাক্ষর করা ব্যাংকের চেকের পাতা।
- পুনর্বাসন ঋণের ক্ষেত্রে প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: লোনের ধরণ অনুযায়ী কাগজপত্রের তালিকা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তাই আবেদন করার পূর্বে আপনার নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখা থেকে বিস্তারিত জেনে নেওয়া উত্তম।
কিভাবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের জন্য আবেদন করবেন?
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার প্রক্রিয়াটি:
ধাপ ১: আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করুন।
ধাপ ২: আপনার নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখায় সরাসরি যোগাযোগ করুন।
ধাপ ৩: ব্যাংক থেকে বিনামূল্যে ঋণের আবেদন ফরম সংগ্রহ করে তা নির্ভুলভাবে পূরণ করুন।
ধাপ ৪: পূরণকৃত ফরমের সাথে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র সংযুক্ত করে নির্ধারিত ডেস্কে জমা দিন।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনার আবেদন এবং কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিক থাকলে ৭-১০ কর্মদিবসের মধ্যেই ঋণ অনুমোদন করে থাকে।
অনলাইনে লোনের কিস্তি পরিশোধ
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক গ্রাহকদের সুবিধার জন্য অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে। আপনি এখন ঘরে বসেই বিকাশ, নগদ, রকেট বা যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং এবং ভিসা/মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে আপনার লোনের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন।
শেষ কথা
প্রবাসীদের আর্থিক সুরক্ষার এক বিশ্বস্ত নাম প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। আপনার যদি কখনও এই ধরণের ঋণের প্রয়োজন হয়, তাহলে দ্বিধা না করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করুন। সঠিক তথ্য যাচাই এবং নিয়মাবলী অনুসরণ করে আপনিও এই বিশেষায়িত ব্যাংকের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।